বন্ধন
পর্ব_৪৬
Bangla Golpo - বন্ধন পর্ব_৪৬ - bangla choti |
বিকেলে তিথি আর তিয়াশের সাথে বেরিয়েছে মায়রা। তিয়াশ ড্রাইভ করছে। ওর পাশে তিথি বসা। আর মায়রা পিছনের সিটে বসেছে। আয়ানের নাম্বারে কল দিয়েছিল বাসা থেকে বের হওয়ার সময়। অনেকক্ষণ কল হয়ে কেটে গেছে। সিটে হেলান দিয়ে বসে মায়রা বাইরের ব্যস্ত শহরটা দেখছে। পাশ দিয়ে সাঁ করে গাড়িগুলো পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে। কিসের এতো ব্যস্ততা সবার? এসব ভাবতে ভাবতে কখন যেন হসপিটালেও পৌঁছে গেছে। কিছুক্ষণ বসে থাকার পর মায়রার নাম ডাকা হলো। তিথি আর মায়রা দুজনে ডাক্তারের চেম্বারে গেল। বেশ কিছুক্ষণ মায়রার সাথে কথা বললেন ডাক্তার। কয়েকটা টেস্ট করানো হলো।
-দেখো মা। এসব টেস্ট হলো ফর্মালিটি। আয়ান তো আসে নি। আসলে কিন্তু এখনই মিষ্টি আনতে পাঠাতাম।
-জি?
-আরে বাবা! সে তো বাবা হবে।
কথাটা শুনেই মায়রা চমকে উঠলো। সত্যি কি ও কথাটা শুনেছে? আয়ান বাবা হবে! তার মানে মায়রা প্রেগন্যান্ট! তিথি পাশ থেকে মায়রাকে জড়িয়ে ধরলো।
-ইয়েএএএ৷ কি মজা! আমি ফুপি হবো। লাভ ইউ ভাবি--।
-আরে? তিথি মা! ভাবিকে একটু খাওয়া দাওয়া করিও। ওর প্রেশার অনেক ফল করেছে। ওয়েটও কম। আর সময়মতো চেকআপ করাতে আসবা। এই সময়টায় একটু সাবধানে থাকতে হবে---।
-জি----।
মায়রাকে টিটি টিকার একটা ইনজেকশন দেয়ার পর তিথি, মায়রা আর তিয়াশ গাড়িতে এসে বসলো। তিথি খুশির চোটে বলতেই পারছে না কি হয়েছে। আর তিয়াশ বেচারা বারেবারে প্রশ্ন করেই চলেছে। মায়রা সেসব নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে আবার আয়ানকে কল করলো। এবারও কল রিসিভ করছে না দেখে মায়রা আয়ানের অফিসের ল্যান্ডলাইনে কল করলো। অনেকক্ষণ কল বাজার পর কলটা রিসিভ হলো।
-হ্যালো? কোথায় আপনি?
-হ্যালো ম্যাডাম? আয়ান স্যার আর আরিশা ম্যাডাম একটা মিটিংয়ে আছেন।
-ওহ!
-স্যারকে কি কিছু বলবো?
-নাহ! কিছু বলতে হবে না। রাখছি।
মায়রা কলটা কেটে দিয়ে কোনমতে নিজেকে সামলে নিয়ে তিয়াশের দিকে তাকালো। তিথি এতোক্ষণে বলে দিয়েছে কথাটা। তিয়াশ হেসে মায়রার মাথায় হাত রাখলো। খুশিতে বেচারা কি করবে, কি বলবে সেটাই বুঝতে পারছে না। লাইফে প্রথম বার মামা হবে সে। অনুভূতিটা এতো সুন্দর হবে তিয়াশ ভাবেও নি।
-ভাইয়া? বাসায় চলো না?
-আয়ান ভাইয়া আসবে না?
-নাহ। ও মিটিংয়ে আছে। কাল তো ওদের প্রজেক্টটার সাবমিট করতে হবে। তাই হয়তো ব্যস্ত। চলো না বাসায় যাই?
-হ্যাঁ হ্যাঁ----।
বাসায় ফিরার পর তিথিকে সবাইকে খবরটা দিয়ে দিল। মায়রার শ্বশুর শাশুড়ি দুজনেই খুশি হয়ে মায়রাকে অনেক দোয়া করলেন। মায়রা সালাম করতে যাচ্ছিলো শাশুড়ীকে। উনি তাড়াতাড়ি মায়রাকে ধরে আটকালেন।
-এই সময় এসব ফর্মালিটির কাজকর্ম করবি না একদম। এভাবে ঝুঁকে সালাম করতে হবে না। ভারি কাজ করা যাবে না। টেনশন করা যাবে না। বুঝলি?
-জি মা।
তিথি ফ্রিজ থেকে মিষ্টি এনে সবাইকে মিষ্টি খাওয়ালো। তারপর মোবাইলটা বের করে আয়ানকে কল করলো। এবারেও কলটা রিসিভ করলো না আয়ান। তিথি বিরক্ত হয়ে আয়ানের অফিসের নাম্বার ডায়েল করছে।
-উফফ। এই ছেলেটাকে এতো বড় নিউজটা দিবো আর সে কলই রিসিভ করছে না। অসহ্য--।
-তিথি? উনাকে এখন বলো না প্লিজ।
-ওমা! কেন?
-না মানে! কাল উনারা প্রজেক্টটা পেলে পরে বলবো।
-ওহো! সারপ্রাইজ দিবা ভাবি? উমমমম। ওকে ডান। এই আম্মু আব্বু---। কেউ ভাইয়াকে বলবা না কিন্তু----।
আটটা কি সাড়ে আটটার দিকে সবাই ডাইনিং রুমে বসে গল্প করছে। আর মায়রা শাশুড়ির বকা খেতে খেতে জুস খাচ্ছে। এমন সময় তিথির মোবাইলে রিং আসতেই তিথি কলটা রিসিভ করলো।
-হ্যাঁ ভাইয়া। বল?
-কি রে? মায়রা কোথায়? ওর ফোনে কল করছি রিসিভ করছে না কেন?
-ওহ। আমরা সবাই তো ডাইনিংরুমে বসে আছি। ভাবিও এখানে। ফোন মনে হয় রুমে ভুলে রেখে এসেছে।
-ওহ! সবাই এখানে মানে? কি করছে? ডক্টর কি বললো?
-তেমন কিছু না। ভাবির প্রেশার লো হয়ে গেছে৷ এই আর কি।
-ওহ! ওকে ফোনটা একটু দে তো?
-হুম----। এই ভাবি কথা বলো?
মায়রা মোবাইলটা কানে লাগালো।
-হ্যালো?
-মায়রু? সরি সরি সরি। কল করেছিলে রিসিভ করতে পারিনি--।
-আরে? কাজ করছিলেন তো। ইটস ওকে। আমি কিছু মনে করিনি।
-সিউর?
-হুম----।
-থ্যাংক ইউ পরীটা। কি করছ এখন?
-মা জুস খেতে দিয়েছে---।
-গুড গুড। খাও--। এই শোনো? আমার আসতে একটু দেরি হবে। তুমি খেয়ে নিও। ওকে?
-হুম----।
-রাগ করো না প্লিজ--?
-হুম। আচ্ছা।
-বায় বউটা৷ টা টা।
আয়ান বাসায় ফিরলো সাড়ে দশটার দিকে। মায়রা চুপ করে শুয়ে আছে চোখ বুজে। আয়ান ফ্রেশ হয়ে এসে মায়রার পাশে শুয়ে পড়লো। মেয়েটা উল্টো দিকে মুখ করে ঘুমাচ্ছে। আয়ান আস্তে করে মায়রাকে টেনে নিয়ে নিজের বুকে সাথে আঁকড়ে জড়িয়ে ধরলো মায়রাকে৷ আয়ানের দিকে পিঠ ফিরিয়ে শুয়ে আছে মায়রা। মায়রাকে জড়িয়ে ধরার কিছুক্ষণের মাঝেই আয়ান ঘুমিয়েও গেল। আয়ানের উষ্ণ নিঃশ্বাস এসে পড়ছে মায়রার কাঁধে। মায়রা আয়ানের হাতের বাঁধন ছাড়িয়ে নিয়ে আয়ানের মুখের দিকে তাকালো। বড্ড বেশি অভিমান হচ্ছে মায়রার। তাই জেগে থাকলেও একটাও কথা বলেনি আয়ানের সাথে। বলবে কেন? আয়ানও তো ওকে একবারও ডাকলো না। বুকে জড়িয়ে ধরলো না। আগের মতো বুকে চেপে ধরে কপালে চুমো খেল না একবারও। একবারও তো মায়রার মুখটা তুলে ধরে জিজ্ঞেস করলো না ডাক্তার কি বলেছে। মায়রা বেশ অনেকটা সরে এসে আবার অপরপাশে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে রইলো। ঘুমে চোখ বুজে আসছে। ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে আসছে। ঘুমের কোলে ঢলে পড়ার আগেও মায়রা টের পেল আয়ানের হাত জোড়া মায়রাকে টেনে নিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে ঘুমের ঘোরেই।
সকালে মায়রার ঘুম ছুটে গেল মোবাইলের রিংটোনের শব্দে। আয়ানের মোবাইলে কল এসেছে। আয়ানের নড়াচড়া টের পেয়ে মায়রা আর চোখ খুললো না। চুপ করে শুয়ে রইলো। আয়ান হাতড়ে মোবাইলটা নিয়ে রিসিভ করে মোবাইলটা কানে লাগালো। আর মায়রাকেও বুকে জড়িয়ে নিলো।
-হ্যালো? আয়ান?
-হুম--। বল আরু।
-একটা সমস্যা হয়েছে রে। লোকেশন সেন্ডিংস ঠিকমতো অপারেট হচ্ছে না। তিনটা নাম্বারে মেসেজ আসার কথা ছিল না? আসছে না একসাথে তিনটাতে। একবার একটা ডিসকানেকটেড হয়ে যাচ্ছে। আমি কিছু বুঝতে পারছি না।
-আরু---। ওয়েট! আমরা কাল রাতেও তো চেক করলাম।
-সেটাই তো। সবগুলো একসাথে রিটেস্ট করছিলাম। তখন দেখি---।
-ওফফফ। ধুর বাবা! ভাবলাম সব টেস্টিং শেষ। বিকেলে একেবারে অফিসে যাবো। আর সন্ধ্যায় সেইফটি ফর উইমেনের পোগ্রামে। ধ্যাত--।
-কি করবি? সমস্যা কি বলে আসে?
-তুই থাক। আমি আসছি---।
-হুম---।
আয়ান কলটা রেখে কিছুক্ষণ চুপ করে শুয়ে রইলো। মায়রাকে আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রইলো কিছুক্ষণ। একটু পরে মায়রার মাথাটা বালিশে রেখে আয়ান উঠে গেল। ফ্রেশ হয়ে এসে ফর্মাল গেটআপ নিলো আয়ান। সাদা ফর্মাল শার্টটার হাতা ফোল্ড করে হাতে ঘড়ি পড়লো। মায়রা ততক্ষণে উঠে বসেছে বিছানায়।
-কোথায় যাচ্ছো?
-উঠে গেছেন ম্যাডাম?
-হুম।
আয়ান চুলটা পিছনের দিকে সেট করে নিয়ে মায়রার পাশে বসে কপালে ছোট্ট করে একটা চুমো খেল।
-অফিসে একটু সমস্যা হয়েছে। অফিসে যাচ্ছি। তুমি আর একটু ঘুমিয়ে নাও না?
-উহু---।
-ওকে। তাহলে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে নাও। পোগ্রাম শুরু হবে সন্ধ্যায় ৭ টার দিকে। মা, বাবার সাথে চলে এসো কেমন?
-হুম-----।
-এখন লক্ষী বউটা৷ আসি? বায়।
-বায়। সাবধানে যেও।
-হুম।
আয়ানের যাওয়ার দিকে মায়রা চুপ করে তাকিয়ে রইলো। খুব কান্না পাচ্ছে। কিন্তু চোখ থেকে এক ফোঁটা পানিও বের হচ্ছে না। মায়রা খাটের সাথে হেলান দিয়েই চুপ করে বসে রইলো। কিছুই ভালো লাগছে না। দূরে কোথাও হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে। যেখানে এতো কিছুর ভাবনা থাকবে না। আয়ানকে হারানোর ভয়টা থাকবে না। আরিশাকে নিয়ে কোন দ্বন্দ্ব থাকবে না মনের কোণে। বা নিজের পরিবার নিয়ে কোন ক্ষোভ থাকবে না। কথাগুলো ভাবছে এমন সময় মায়রার মোবাইলটাও শব্দ করে বেজে উঠলো। মোবাইলটা হাতে নিয়েই ভ্রু কুঁচকে গেল মায়রার। সেই বিয়ের দিনে চোরের মতো এসে বেশ দামি কিছু গয়না দিয়ে গিয়েছিলেন উনি। আজ আবার হঠাৎ কলও করছে? কি চলছে উনার মনে? মায়রার কাছে কি চায় উনি?