Bangla Golpo - বিষন্নতার শেষ বিকেল (পর্ব ৫) - love story - bangla choti golpo - life story

 

বিষন্নতার শেষ বিকেল (পর্ব ৫)

Bangla Golpo - বিষন্নতার শেষ বিকেল (পর্ব ৫) - love story - bangla choti golpo - life story


Bangla Golpo - বিষন্নতার শেষ বিকেল (পর্ব ৫) - love story - bangla choti golpo - life story 

আজ ছুটির দিন। কামরান আহমেদ দুপুরের খাবার খেয়ে বারান্দার আরাম কেদারায় হেলান দিয়ে শুয়ে আছন। মেখলা পাশে একটা উঁচু টুলে বসে বাবার কপালটা চেপে দিচ্ছে। কামরান সাহেবের এই মুহুর্তটা খুব ভালো লাগে। মেয়ের সাথে টুকটাক গল্প হয়। 


মেখলা দুই আঙুল দিয়ে দু'পাশ থেকে কপালের চামড়াটা মাঝখানের দিকে টেনে এনে মৃদু গলায় জিজ্ঞেস করে, 'আচ্ছা বাবা, একটা আইসক্রিম ফ্যাক্টরি দিতে কত টাকা লাগে?' 


কামরান আহমেদ আরামে চোখ মুদে ছিলেন, মেখলার প্রশ্নটা শুনে একবার চোখ খুলেন, তারপর আবার চোখ বন্ধ করে বলেন, 'হঠাৎ আইসক্রিম ফ্যাক্টরির খোঁজ নিচ্ছিস যে?' 


মেখলা মাথাটা চাপতে চাপতে বলে, 'বাবা, আমি নিজের একটা আইসক্রিম ব্র‍্যান্ড দাঁড় করাতে চাই।' 


কামরান সাহেব চোখ বন্ধ করেই মাথা দোলান, বলেন, 'বাবার ব্যবসায় বসবি না তাহলে?' 


গলায় একটা অভিমান টের পায় মেখলা। বাবার মাথায় আদরে হাত বুলিয়ে বলে, 'অবশ্যই বসব বাবা, তার আগে আমি নিজে একটা কিছু করে দেখতে চাচ্ছি। আমি আবিস্কার করলাম এই একটা ব্যাপারে আমি খুব আনন্দ পাচ্ছি।'


কামরান এবার চোখ খোলেন, একটু ভেবে বলেন, 'বাংলাদেশের আইসক্রিম শিল্প সম্পর্কে তুই কতটুকু জানিস?' 


মেখলা হেসে বলে, 'বাবা আমার পরীক্ষা নিচ্ছে। হুম, বাংলাদেশে আইসক্রিমের মোটামুটি পনেরশ কোটি টাকার মার্কেট, প্রতি বছর এর ১৫% প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। গত করোনায় অবশ্য বিক্রি কমে ছয়শ কোটিতে নেমে এসেছিল। এখন আবার আগের জায়গায় ফিরছে। আর দিন দিন শিল্পটা বাড়ছেই, তার দুটো কারণ - এক, বিদ্যুৎ এর আওতায় আসা মানুষের সংখ্যা বেড়েছে, তাতে করে ফ্রিজের সংখ্যাটাও। আবার জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে গরম কালের ব্যাপ্তিও বাড়ছে। তাই আইসক্রিমের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। আর দেশের মাত্র দুইটা বড় কোম্পানি ৬০% উপর শেয়ার উপভোগ করছে। ভালো মানের কেউ যদি এগিয়ে আসে তাহলে এই মার্কেট দখল করা খুব সহজ হবে।' 


সেদিন রাফসানের কাছে সেই মার্কিন দু'জন আইসক্রিম উদ্যোক্তার কথা শুনে ও খুব অনুপ্রাণিত হয়েছে। এই ক'দিন মেখলা খুব পড়াশোনা করেছে, রাফসানও ওকে তথ্য দিয়ে সাহায্য করেছে। আইসক্রিমের এই তথ্য জানতে চাওয়াতে রাফসানও খুব অবাক হয়েছিল। কিন্তু মেখলা ওকে এখনও কিছু বলেনি। 


কামরান আহমেদ এবার সোজা হয়ে বসেন, অবাক চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকেন। কবে কবে মেয়েটা এমন সিরিয়াস হয়ে গেল। খুব ভালো লাগা নিয়ে বলেন, 'আমি আজ নিশ্চিন্ত। আমার মেয়ে যেভাবে ভাবতে শিখেছে সে ঠিক আমার ব্যবসার হাল ধরতে পারবে।' 


মেখলা বাবার হাতটা চেপে ধরে বলে, 'বাবা, তুমি রাগ করোনি তো?' 


কামরান স্নেহের গলায় বলেন, 'তোর মাঝে আমি নিজেকে দেখতে পাচ্ছি। একদম নতুন উদ্যোক্তার মতোই চিন্তা ভাবনা। আমিও ঠিক এমন করেই ভাবতাম। তুই এগিয়ে যা, আমি আছি তোর পাশে।' 


মেখলার সারা মুখ জুড়ে একটা আত্মবিশ্বাসের আলো ফুটে ওঠে, রাফসানের কথা একবার মনে হয়, ও পুরোটা শুনলে দারুণ খু্শি হবে।


২.

রাফসান মাসের খরচের হিসাবটা করছিল। এ মাসে সুমির সেমিস্টার ফি দিতে হবে। বাবাকে একবার ডাক্তারও দেখানো দরকার। ইদানীং প্রেশারটা ঠিকঠাক থাকছে না, সাথে ডায়াবেটিসটাও বেড়েছে। আম্মার ভাষ্যমতে বাবা নিশ্চিত লুকিয়ে লুকিয়ে বাইরে মিষ্টি খায়। এই নিয়ে মায়ের সাথে বাবার আজ একচোট হয়ে গেছে। রাফসান বাবাকে বুঝিয়েছে, একটু দেখে শুনে না চললে যে মুশকিল। কিন্তু এখন তার চেয়েও বড় মুশকিল হলো এ মাসে ও যা বেতন পেয়েছে তা দিয়ে এই খরচ সামাল দিতে হলে মাস শেষে ঠিক কিছু টাকা ধার করতে হবে। একটা নিশ্বাস ফেলে ভাবে, সামনের বছর প্রমোশনটা হলে হয়ত টানাটানি কিছুটা কমবে। সাথে আরেকটা কথা মনে হতেই মনটা খারাপ হয়ে যায়। শানু ওকে ছেড়ে চলে গেছে ঠিকই হয়েছে, বেচারা শুধু শুধু ওর এই টানাটানির জীবনের সাথে জড়িয়ে হাঁসফাঁস করত। সুখে থাকত না, প্রেমটা নিশ্চয়ই ফিকে হয়ে যেত। জীবনে আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যটা যে খুব জরুরি। 


আনমনে এসব যখন ভাবছে ঠিক তখন মেখলার মেসেজটা আসে, 'এই যে আইসক্রিমওয়ালা, আজ সন্ধ্যায় কী একটু ফুচকা খেতে আসবেন? আমাদের সেই বিখ্যাত ডিসিসি মার্কেটে?'


বহুদিন পর মেখলা ওকে ডাকল দেখা করার জন্য।রাফসান মেসেজটা পড়ে হাসে, লিখে, 'একটু না, আজ পেট পুরেই ফুচকা খাব। আইসক্রিমওয়ালা।' 


মেসেজটা পাঠিয়ে রাফসান দ্রুত হাতের কাজগুলো গুছিয়ে নেয়। আজ রবিবার, গুলশানের ওদিকটা বন্ধ। তাই পৌঁছাতে ওর খুব একটা সময় লাগে না। এই দিনটাতেই এদিকে আসা ভালো। খাবারের দোকানগুলোই শুধু খোলা থাকে। রাফসান বাইকটা পার্ক করে হাসান মামার ফুচকার দোকানের দিকে এগোতেই অবাক হয়ে খেয়াল করে মেখলা আজ আগেই চলে এসেছে। ব্যাপারটা কী? 


কাছে আসতেই মেখলা উচ্ছ্বসিত গলায় বলে, 'ইশ আমি কখন থেকে অপেক্ষা করছি আপনার জন্য!' 


রাফসান আজ মেখলার চোখেমুখে একটা আনন্দ, একটা উত্তেজনা দেখে, যেটা এতদিন বিষাদে ঢাকা থাকত। কী হলো মেয়েটার, নতুন কাউকে ভালোবেসে ফেলল? কথাটা ভাবতেই কেন জানি ওর মনটা খারাপ হয়ে যায়। 


শুকনো মুখে বলে, 'অফিস শেষ করে একটু দেরিই হয়ে গেল। তা বলুন, এতদিন বাদে আপনার মনে পড়ল বুঝি!'


রাফসানের গলায় সূক্ষ্ম একটা অভিমান টের পায় মেখলা। একটু থমকে যায়, তারপর ব্যাপারটা গুরুত্ব না দিয়ে ও হইহই করে বলে, 'আপনার চাকরিটা ছেড়ে দিতে হবে।' 


রাফসান কিছু বুঝে উঠতে পারে না, অনিশ্চিত গলায় বলে, 'বুঝলাম না আপনার কথা। চাকরি ছাড়ব মানে?' 


মেখলা এবার রহস্যময় গলায় বলে, 'আরে আপনি নিজেই এখন সত্যিকারের আইসক্রিমওয়ালা হয়ে যাবেন। আপনার কাছে সেদিন আইসক্রিমের গল্প শুনে আমি বাবাকে বলেছিলাম। বাবা আমাকে আপাতত ছোট একটা পুরনো আইসক্রিম ফ্যাক্টরি কিনে দিচ্ছেন। আমি এর মাঝে আইসক্রিমের একটা অনলাইন কোর্সে ভর্তি হয়ে গেছি। কিছু ভালো লোকও নেব। আর তুমি হবে আমার আইসক্রিম ফ্যাক্টরির মার্কেটিং হেড। আমার খুব ইচ্ছে নতুন নতুন ফ্লেভারের আইসক্রিম নিয়ে আসব, আর তোমার সাথে দুর্দান্ত সব মার্কেটিং প্ল্যান করব। আমি আমার ব্র‍্যান্ড দাঁড়া করাবই। আমি নামও ঠিক করে ফেলেছি, Avalanche, মানে হিমবাহ। একটা দারুণ প্যাকেজিং ভেবে রেখেছি তোমাকে দেখাব।  চাকরিটা ছেড়ে দাও, দেখো আমরা দু'জন কী করি!'


বলতে বলতে মেখলার চোখেমুখে একটা উজ্জ্বল আলো খেলা করতে থাকে। উত্তেজনায় যে ওকে তুমি বলে ফেলেছে সেটাও খেয়াল নেই। আর এদিকে রাফসান ভাবে, মানুষের যখন খাওয়া পড়ার চিন্তা থাকে না, ছোট বোনের টিউশন ফি নিয়ে ভাবনা থাকে না, বাবার চিকিৎসা নিয়ে ভাবতে হয় না তখন এমন আকাশ কুসুম ভাবতে পারে। ইচ্ছে হলেই একটা কিছু করে ফেলল, পরে ভালো না হলে বন্ধ করে দিল। কিন্তু ওর যে এমন করা যাবে না।


রাফসান নিরাসক্ত গলায় বলে, 'মেখলা আপনি শুরু করেন। আমি তো আছিই, যখন লাগবে আমার মার্কেটিং বুদ্ধি দিয়ে আপনাকে সাহায্য করব। কিন্তু চাকরিটা এখন আমার পক্ষে ছাড়া সম্ভব না। আপনার বাবার অনেক টাকা আছে, লাইফ নিয়ে আপনি এক্সপেরিমেন্ট করতেই পারেন, কিন্তু আমি তো পারব না।'


মেখলার আলোকিত মুখটা মুহুর্তে নিভে যায়, ও বিশ্বাসই করতে পারছে না যে রাফসান ওকে না করবে। ও কত আশা নিয়ে এসেছিল রাফসানের কাছে। এমনকি বাবাকেও রাফসানের কথা বলেছিল ও। বাবা খুব খুশি হয়েছিলেন রাফসানের কথা শুনে। এখন ও বাবাকে কী জবাব দেবে?


আর রাফসানও এই কথাটাই বলল! ওর বাবার টাকা আছে তাই ও লাইফ নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করতে পারে! 


সম্পর্কের শেষ দিকে তানভিরও ওকে বলেছিল ও ধনীর দুলালি, ওটা ছাড়া নাকি ওর কোনো যোগ্যতাই নেই। জীবনে নিজের যোগ্যতায় নাকি কিছুই করতে পারবে না। তাই ও চেয়েছিল নিজেই কিছু একটা করে দেখাতে। রাফসানের সাথে পরিচয় হয়ে, ওর উদ্যম দেখে সাহস পেয়েছিল। আর রাফসান এমন করে ওকে বলতে পারল? মনটা আবার বিষন্ন হয়ে যেতে থাকে। যে বিষন্নতা ও কাটিয়ে উঠতে চেয়েছিল সেটা আবার ওকে ঘিরে ধরতে চায়।


নিচু গলায় বলে, 'আমার একটু কাজ আছে, বাসায় যেতে হবে।' 


কথাটা বলে মেখলা আর দাঁড়ায় না, দ্রুত গাড়িতে উঠে চলে যায়। রাফসান মন খারাপ করা একটা চোখে ওর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। হাসান মামা দুই প্লেট ফুচকা এনে ওর সামনে রাখতেই বুঝতে পারে ঝামেলা হয়েছে। এখানে এমন হয় মাঝে মাঝে, এত অভ্যস্ত ও। রাফসান মন খারাপ নিয়ে ফুচকার দাম মিটিয়ে উঠে পড়ে। এলোমেলো হাঁটতে থাকে, ওর আসলে কী করার আছে? এমন নিশ্চিন্ত চাকরিটা ছেড়ে যে ঝুঁকি নিতে পারে না এটা বোঝাবে কী করে? মেখলার মুখটা আবার সেদিনের মতো মেঘলা হয়ে গিয়েছিল, ভাবতেই মনটা বিষন্ন হয়ে ওঠে।


মেখলা গাড়িতে উঠে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করে, পারে না। হুট করেই কান্না পেয়ে যায়। কেন ওর সাথেই এমন হয়? এত অল্পতেই কেন ও এত আশা করে বসেছিল যে রাফসান রাজি হয়ে যাব? প্রতিটা মানুষের একটা নিজস্ব ভাবনা থাকে, জীবনের আলাদা ছক থাকে। সেটা যে মিলবে সবসময় তা তো না। 


মেখলা চোখটা মুছে ফেলে, তারপর মন শক্ত করে একটা সিদ্ধান্ত নেয়। ও ওর স্বপ্নের পথে এগিয়ে যাবে, তাতে কেউ ওর সাথে থাকুক বা নাই থাকুক।


৩.

মেখলা আজ ভোরেই ঘুম থেকে উঠে ফজরের নামাজটা পড়ে অনেকক্ষণ দোয়া করেছে। আজ ওর জীবনের একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ আর আনন্দের দিন। শেষ পর্যন্ত ওর Avalanche আইসক্রিমটার আনুষ্ঠানিক উদবোধন হচ্ছে। এই ক'টা মাস ও এত বেশি পরিশ্রম করেছে যে এক সময় আম্মু খুব রাগ করেছে। অবশ্য বাবা উৎসাহ দিয়েছে, সব কাজে পাশে থেকেই সাহায্য করেছে। অবশেষে ওর স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল এ বিশাল আয়োজন করেছে। মিস কোহেকাফকে দিয়েই উদবোধনটা করবে। 


রেগলার আইসক্রিম কোম্পানির একজন পুরনো, অভিজ্ঞ মার্কেটিং ম্যানেজার নিয়েছে। এর মাঝে নিজে এক মাস বিদেশে হাতে কলমে আইসক্রিমের খুঁটিনাটি ও শিখে এসেছে। নিয়ম অনুযায়ী আইসক্রিমে ১২% মিল্ক ফ্যাট থাকার কথা, অনেক কোম্পানিই এটা মানে না। কি করে ফ্লেভারটা ধরে রাখতে হয়, ফলের নির্যাস দিয়ে আরও মজাদার করা যায় সেটাও দেখে এসেছে। আপাতত এক লিটারের চকলেট ফ্লেভারের একটাই ব্র‍্যান্ড লঞ্চ করবে। তারপর ধীরে ধীরে অন্য আইডিয়াগুলো কাজে লাগাবে। 


একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবে রাফসান থাকলে খুব ভালো হতো। কিন্তু ও আর যোগাযোগ করেনি, মেসেজও দেয়নি। সেদিন ওভাবে চলে আসার পর ও ভেবেছিল সব ভুলে কাজে মনোযোগ দেবে। রাফসানের কথা মনে পড়বে না। কিন্তু ও অবাক হয়ে খেয়াল করেছে যে প্রতিদিন ও মনে মনে রাফসানের মেসেজের জন্য অপেক্ষা করে থাকে। কেন জানি নিজে থেকে যোগাযোগ করতে ওর বাধো বাধো ঠেকে। আবার সেই সাথে একটা রাগও হয়, ওর একটা স্বপ্ন যে মানুষটা ওর হয়ে ভাবতে পারে না তার কথা ও ভাবতে যাবে কেন?


৪.

রাফসানের আজ জরুরি একটা মিটিং চলছে, এবং যে বিষয়টা নিয়ে মিটিং তার মূল প্রেজেন্টেশনটা রাফসানকেই দিতে হচ্ছে। আর সবচেয়ে কষ্টের যে ব্যাপার সেটা হলো বাজারে নতুন একটা আইসক্রিম ব্র‍্যান্ড এসেছে, Avalanche. এই ব্র‍্যান্ড যাতে দাঁড়াতে না পারে সেজন্য ওকে স্ট্রাটেজি দিতে বলা হয়েছে। আজ তারই প্রেজেন্টেশন, স্বয়ং চেয়ারম্যান স্যারও মিটিংয়ে উপস্থিত। 


ওর সুপারভাইজার রেজা আলম ওকে ইশারা করতেই ও শুরু করে, 'স্যার, বাজারে নতুন কোনো ব্র‍্যান্ড আসাকে আমি আসলে পজিটিভলি দেখতে চাই।' 


রেজা ভাই ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে তাকায়, চেয়ারম্যান বজলুর রশিদ স্যার নড়েচড়ে বসে বলেন, 'কী করে সেটা?' 


রাফসান লম্বা একটা নিশ্বাস নিয়ে বলে, 'স্যার, বাজারে নতুন কম্পিটিটর আসা মানেই আমাদের আইসক্রিম শিল্প নিয়ে পজিটিভ কথা বলার মানুষের সংখ্যা বাড়ল। এরা যত বেশি প্রচার করবে তাতে কিন্তু আইসক্রিমের ভালো দিকগুলোই বলবে। আগে শুধু আমরা সহ কয়েকজন বলতাম, এখন নতুন একজন বলবে। এতে মার্কেটে যাদের ব্র‍্যান্ড শক্তিশালী তাদের বিক্রিটাই উলটো বাড়বে, যদি না খুব নতুন কোনো কনসেপ্ট নিয়ে আসে। আর পেশাগত যে লড়াই, সেটা তো থাকবেই। আমরা ইতিমধ্যেই আমাদের সব স্টেকহোল্ডারদের জন্য আগামী কয়েক মাস কেউ বিশ লিটার আইসক্রিম অর্ডার করলে এক লিটার ফ্রি দিচ্ছি। আর যারা মাসে পাঁচশ লিটার বিক্রি করবে তাদের জন্য কক্সবাজার ট্যুর থাকবে। আর আমাদের আইসক্রিমের গুণাগুণ, পুষ্টিমান এগুলো নিয়ে নিয়মিত ক্যাম্পেইন তো থাকবেই।' 


চেয়ারম্যান বজলুর রশিদ স্যার হাততালি দিয়ে বলেন, 'বাহ, চমৎকার বললে তো তুমি। বিশেষ করে নতুন প্রতিপক্ষ যে উলটো আমাদের জন্য ভালো এটা ভেবে দেখেনি। অনেক ধন্যবাদ রাফসান, আমার বিশ্বাস তোমার এই স্ট্রাটেজি Avalanche ব্র‍্যান্ডকে দাঁড়াতেই দেবে না।' 


উপস্থিত সবাই এবার চেয়ারম্যান স্যারের সাথে সুর মেলায়, এমনকি ওর সুপারভাইজার রেজা ভাইও এবার ওর পক্ষে কথা বলে। সবাই বাহবা দেয় ওকে, কিন্তু কেন জানি ওর এসব কিছুই ভালো লাগছিল না।


আজ ছয়মাস হয়ে গেছে মেখলার সাথে যোগাযোগ নেই, মেসেজ নেই। ও প্রতিদিন ভাবে আজ একটা ফোন দেই, কিন্তু নিজেকে গুটিয়ে নেয়। মেখলা যেমন করে ভাবে তাতে যে খাপ খাইয়ে নিতে পারে না। প্রথমে ভেবেছিল এটা মেখলার খামখেয়ালি ভাবনা। কিন্তু মাসখানেক আগেই সেদিন খবরের কাগজে Avalanche আইসক্রিমের বিজ্ঞাপন দেখতে পেয়েছে, সেই কোহেকাফ ম্যাডামকে দিয়েই বিজ্ঞাপনটা করেছে ওরা। টিভিতেও মাঝে মাঝে বিজ্ঞাপন দেখা যায়।

তার মানে মেখলা জেদ করে তাড়াহুড়ো করেই প্রোডাক্ট লঞ্চ করল। সেজন্যই আজ এই মিটিং, Avalanche কে ঠেকাতে।


রাফসান ভাবে ব্যাপারটা কত সোজা মেখলাদের জন্য। চাইলেই এমন বড় একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলতে পারে। অথচ এমন একটা আইসক্রিমের ব্র‍্যান্ড নিয়ে ও যদি কাজ করতে পারত! অবশ্য মেখলা সে সুযোগটা দিয়েছিল ওকে, কিন্তু মেখলার মতো ও তো ঝুঁকি নিতে পারে না। পুরো পরিবারটা ওর উপর নির্ভরশীল। 


যেদিন আইসক্রিমটা লঞ্চ হয় সেদিনই ভেবেছিল ফোন দেবে, কিন্তু মেখলা ওকে একবারও বলেনি তাই ও আর আগ বাড়িয়ে ফোন দেয়নি। অবশ্য চাকরির খাতিরেই Avalanche আইসক্রিমের খোঁজ খবর রাখতে হয়। হাজার হলেও মেখলা ওদের সরাসরি প্রতিপক্ষ এখন। রাফসান মোটামুটি ঘুরে দেখেছে, দোকানদাররা ওদের আইসক্রিম ভালোই তুলেছিল। কিন্তু সেই তুলনায় বিক্রি একদম কম। রাফসান জানে, এরা ফেলে রাখবে, তারপর কিছুদিন পর সব আইসক্রিম ফেরত পাঠাবে। দোকানদারদের তো লস নেই, ওরা ক্রেডিটে আইসক্রিম নিয়েছে। 


এর ঠিক এক মাস পর রাফসান গুলশানের একটা নামকরা আইসক্রিম পার্লারে খোঁজ নেয়, তারপর ফার্মগেট এলাকায়, তারপর ইউনিভার্সিটি এলাকায়, সব জায়গায় ও একই ফিডব্যাক পায়। Avalanche আইসক্রিমের বিক্রি তলানিতে। মনটা খারাপ হয়ে যায়। মেখলার অসহায় মুখটা ভেসে ওঠে। নিশ্চয়ই মেয়েটা ভীষণ ভেঙে পড়েছে। যত দিন যাবে ব্যবসায় তত লস হবে, আর ততই ভাঙতে থাকবে।


সেদিন ফেরার পথে যখন একটা ট্রাফিক সিগন্যালে দাঁড়িয়েছিল পাশেই একটা প্রাইভেট কার দাঁড়ানো, ভেতরে একটা মেয়ে বসা। হঠাৎ করেই রাফসানের সেদিনের কথা মনে পড়ে যায়। একটা মেয়ে কেমন বুক উদাস করা কান্না কাঁদছিল। ভীষণ মায়া হয় রাফসানের, ওর মনে হয় ও ভীষণ ভুল করেছে। মেয়েটা জীবনে ঘুরে দাঁড়াতে চেয়েছিল, ওকে পাশে চেয়েছিল। আর ও কি না ভয় পেয়ে পিছিয়ে আসলো? অন্তত ছুটির দিনগুলোতে পাশে থাকতে পারত। 


সেদিন রাতে বাসায় ফিরে ও Avalanche আইসক্রিমের অফিসের ঠিকানাটা খুঁজে বের করে। তারপর মনের সাথে কিছুক্ষণ যুদ্ধ চলে, শেষ পর্যন্ত ও সিদ্ধান্ত নেয় ও যাবে আগামীকাল, মেখলার কাছে।


(চলবে)

Next part 

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.