বিষন্নতার শেষ বিকেল (পর্ব ২)
Bangla Golpo pdf - বিষন্নতার শেষ বিকেল (পর্ব ২) - bangla choti - love story - life story |
গুলশানের পাঁচতারকা হোটেল ওয়েস্ট ইন এ আজ দেশের একটা নামকরা আইসক্রিম কোম্পানি তাদের নতুন একটা ব্র্যান্ড লঞ্চ করবে। এই লঞ্চিং প্রোগ্রামের পুরো দায়িত্বে আছে রাফসান, যদিও ও নতুন কিন্তু বস ওকেই দায়িত্বটা দিল। এই দু' বছরে রাফসানের উপর এরা অনেকখানি ভরসা রেখেছে।
পড়াশোনা শেষ করে ও যখন জীবনের রিলে রেসে বাবার হাতের ব্যাটনটা নেবার প্রাণপণ চেষ্টা করছিল ঠিক তখন এই আইসক্রিম কোম্পানিতে চাকরিটা হয়ে যায়। পুরো পরিবারটা যেন হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছিল, বাবার চাকরির শেষ মাসেই রাফসানের চাকরিটা হয়। তাই জীবনের ছন্দপতন টের পাওয়া হয়নি।
রাফসান আজ পুরো কর্পোরেট সাজে সেজে এসেছে, কালচে নীল রঙের স্যুট সাথে হালকা রঙের শার্ট, মানানসই টাই। পুরোটা রুম একবার চক্কর দেয়, সব ঠিক আছে। মঞ্চের সামনেই একটা কাঠের বক্স রাখা, সেটার ভেতর থেকেই আইসক্রিমের একটা ডামি ঘুরে ঘুরে উপরে বের হয়ে আসবে সাথে লাল নীল বাতির ঝলক থাকবে, আর ব্যাকগ্রাউন্ডে তখন হাই ভলিউমে মিউজিক বাজতে থাকবে। এর মধ্যেই রাফসান কয়েকবার পুরোটা ডামি ট্রায়াল দিয়ে দেখেছে। প্রোগ্রামটার সফলতার উপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। তাতে ওর সামনের পথচলা মসৃণ হয়ে যাবে।
এই যখন ভাবছে ঠিক তখন একটা রিনরিনে গলার ডাকে ও ঘুরে তাকায়, 'এই ছেলে, এদিক আসো তো। আমাকে তোমাদের নতুন আইসক্রিমগুলো দাও। আর আমার সাথে কয়েকজন এসেছে, ওদেরও। দেখি তোমরা কী আইসক্রিম বানালে।'
রাফসান তাকিয়ে দেখে মিস কোহেকাফ, হালের নামকরা মডেল। ওনাকে এই নতুন আইসক্রিমটার ব্র্যান্ড এম্বাসাডর করে আনা হয়েছে। কোম্পানির উচ্চপদস্থ লোকদের সাথে উনিও একই সাথে বাটন চেপে আজকের লঞ্চিংটা করবেন। তারপর আইসক্রিম হাতে কয়েকটা ফটোশ্যুট হবে, তার জন্য রাফসান পাশেই একটা আইস বক্সে কিছু আইসক্রিম নিয়ে এসেছে। কিন্তু এই মডেল যদি এখন সেগুলো খেয়ে ফেলেন তাহলে পরে কোথায় আইসক্রিম পাবে ও! আবার একে নাই বা করে কী করে?
রাফসান এবার মুখে একটা মধুর হাসি ফুটিয়ে বলে, 'ম্যাডাম, আপনি তো সরাসরি দেখতে আরও সুন্দর! আজ কিন্তু আপনার আইসক্রিম হাতে ফটোশ্যুট আছে। এখন খাবেন আইসক্রিম? যদি হঠাৎ করে জামায় পড়ে যায়? আর এত সুন্দর লিপিস্টিকটাও নষ্ট হয়ে যাবে তো? তার চেয়ে প্রোগ্রাম শেষে আপনার গাড়িতে আমি এক বক্স আইসক্রিম উঠিয়ে দেব, বাসায় যেয়ে আরাম করে খাবেন।'
শেষ কথাটা মনে ধরে মিস কোহেকাফের, রাফসানের দিকে তাকায়, তারপর মিষ্টি সুরে বলে, 'ওয়াও, কী সুইট তুমি। তোমার নাম কী?'
রাফসান হেসে বলে, 'ম্যাডাম, আমি রাফসান, আজকের ইভেন্টের দায়িত্বে আছি। কিছু লাগলে আমাকে বলবেন।'
মিস কোহেকাফ চোখে একটা মাদকতা মিশিয়ে বলে, 'রাফসান, আমার যে একটা রুম লাগবে। তোমাদের অনুষ্ঠান তো শুরু হতে দেরি আছে, আমি একটু রেস্ট করব।'
রাফসান বিরক্ত হয়ে ভাবে এই মডেল তো একটার পর একটা চাহিদা দিয়েই যাচ্ছেন। এখন ওনার জন্য একটা রুমে নেবে! কী করা যায়? রাফসান একটু চিন্তা করে বলে, 'ম্যাডাম, আমাদের দেরি হবে না। চেয়ারম্যান স্যার প্রায় চলে এসেছেন, বলেছেন আপনার সাথে নাকি কফি খাবেন। আর, ভবিষ্যতে আপনার সাথে নতুন নতুন কি কি কাজ করা যায় তার জন্য বসবেন।'
মিস কোহেকাফ কিছুদিন আগেই বত্রিশশো স্কয়ার ফিটের একটা নতুন ফ্ল্যাট বুকিং দিয়েছেন, তার জন্য অনেক টাকা দরকার। তাই রাফসানের কথাটা ভালো লাগে। সেটা ওকে বুঝতে না দিয়ে বলে, 'আচ্ছা, আমি ভেবে জানাব। আর আমি আপাতত এখানেই অপেক্ষা করছি।'
রাফসানের পুরো ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ে। যাক, ম্যানেজ করা গেছে মিস কোহেকাফকে। এবার ও দ্রুত সামনে এগিয়ে যায়, চেয়ারম্যান স্যার সত্যিই চলে এসেছেন।
অনুষ্ঠান শুরু হয়ে যায়। শহরের সুধীজন থেকে শুরু করে ইউনিভার্সিটি, কলেজ পডুয়া কিছু ছেলেমেয়েকেও নিয়ে আসা হয়েছে। রাফসান প্রথমেই সবাইকে স্বাগত জানিয়ে নতুন আইসক্রিমটার একটা ছোট্ট, আকর্ষণীয় প্রেজেন্টেশন দেয়। মূল ফোকাস পয়েন্ট থাকে লো ফ্যাটে, যেটা স্বাস্থ্যকর। এই আইসক্রিমটা আলমন্ড দিয়ে সাজানো, দারুণ মজা। আজকালকার মানুষ যেহেতু ওজন নিয়ে খুব সচেতন তাই এই লো ফ্যাটের আইসক্রিমটা নিয়ে আসা। আইডিয়াটা রাফসানের, চেয়ারম্যান স্যার খুব পছন্দ করেছিলেন।
পুরো অনুষ্ঠানটা বেশ সুন্দর করেই শেষ হয়। মিস কোহেকাফ আইসক্রিম খাওয়ার কয়েকটা দুর্দান্ত শট দেয়। নাহ উনি আসলে কাজের ব্যাপারে সিরিয়াস। ছবিগুলো দারুণ কাজে আসবে। রাফসান এবার সত্যি সত্যি ওনার গাড়িতে এক বক্স আইসক্রিম দিয়ে দেয়। যাবার সময় মিস কোহেকাফ ওর দিকে তাকিয়ে দারুণ একটা হাসি দিয়ে বলে, 'তোমার প্রেজেন্টেশন খুব সুন্দর হয়েছে। তুমি উন্নতি করবে।'
রাফসানের মনটা ভালো হয়ে যায়, দিনশেষে এটাই ওর প্রাপ্তি। মিস কোহেকাফের উপর বিরক্তিগুলো চলে যায়। ও হেসে বিদায় জানায় কোহেকাফকে।
সব শেষ করে যখন বের হয় ততক্ষণে প্রায় বিকেল হয়ে গেছে। রাফসান আজ আর অফিস ফিরে যায় না। পরনের টাইটা খুলে ব্যাগে নেয়, ব্লেজারটা খুলে ভাঁজ করতে যেয়েও থেমে যায়, নাহ ব্লেজারের ভাঁজ নষ্ট হয়ে যাবে। বাইরে বের হতেই গরমটা টের পায়। ব্লেজার পরা থাকাতে গরমটা যেন আরও বেশিই লাগছে।
রাফসান বাইকটা স্টার্ট করে এগোয়। গুলশান এক নাম্বারের কাছে আসতেই ট্রাফিক সিগন্যালে ও দাঁড়ায়। আকাশের দিকে তাকাতেই নীল আকাশে শুভ্র সাদা মেঘ ভেসে যেতে দেখে। রাফসানের হঠাৎই মনে হয় শরৎকাল চলছে। কথাটা মনে হতেই ওর মনে পড়ে যায় সামনেই গুলশান এক এর ডিসিসি মার্কেটে কাইয়ুমের দোকানে পুজো সংখ্যাগুলো পাওয়া যায়। আর দেরি করে না, সিগন্যালটা ছাড়তেই ও ডান দিকে যাবার ইন্ডিকেটর লাইট জ্বালিয়ে বাইকটা টান দেয়।
২.
ডিসিসি মার্কেটের সামনেই বড় পার্কিং, এই বিকেলে অনেক গাড়ির ভীড়। বাইকটা কোথায় রাখা যায় তাই ঘুরে ঘুরে দেখছিল। শেষে একটা গাড়ির পাশে ছোট্ট একটা জায়গা খালি পেতেই রাফসান দ্রুত বাইকটা পার্ক করে। বাইকটা লক করে নামতেই হঠাৎ গাড়িটার দিকে তাকায়, তারপর নাম্বার প্লেটের দিকে তাকাতেই বুকটা চলকে ওঠে, এটা তো কালকের গাড়িটা, টয়োটা প্রিয়াস। কালকে এতবার নাম্বারটা দেখেছে যে মুখস্থ হয়ে গেছে। মেয়েটা এখানে এসেছে! উম, অবশ্য আসতেই পারে, নিকেতনের তো একদম কাছেই ডিসিসি মার্কেট।
রাফসানের মাথায় আবার কালকের পোকাটা নড়ে ওঠে, আচ্ছা মেয়েটা অমন কাঁদছিল কেন? আজ দেখা হলে জিজ্ঞেস করা যাবে। সম্পূর্ণ একটা অবাস্তব ভাবনা, কিন্তু কেন জানি রাফসানের কাছে এটাই দারুন বাস্তব বলে মনে হয়। রাফসান আশেপাশে তাকায়, তারপর মার্কেটের ভেতর দ্রুত একটা চক্কর দেয়। নাহ, কোথাও নেই। কিন্তু অমন এক দেখাতে মেয়েটার মুখ মনে থাকার কথাও না অবশ্য। রাফসান সিদ্ধান্ত নেয় তার চেয়ে পুজো সংখ্যাগুলো কিনে গাড়িটার পাশেই অপেক্ষা করা ভালো। কিন্তু মেয়েটা ওর সাথে কথা বলবেই বা কেন? যদি বলেও তাহলে হুট করে তো জিজ্ঞেস করা যায় না, আপনি গতকাল গাড়িতে কান্না করছিলেন কেন?
কথাটা ভাবতে ভাবতে কাইয়ুম মামার দোকানে দাঁড়াতেই মামা এক গাল হাসি দিয়ে বলে, 'মামা একদম সময়মতো আইছেন। আপনার লাইগা দেশ পত্রিকা, নবকল্লোল সহ আর সবগুলা গল্পের সংখ্যা আলাদা কইরা রাখছি। আর একটু পর আইলে দেশ পত্রিকা আর পাইতেন না।'
রাফসান হাসে, এখান থেকে ও নিয়ম করে ইদ সংখ্যা, পুজো সংখ্যাগুলো কেনে। অবশ্য যারা কেনে তারা নিয়ম করে একটা জায়গা থেকেই কেনে। তাই কাইয়ুম মামা সবার মুখই মনে রাখে।
পুজো সংখ্যাগুলো সুন্দর করে প্যাকেট করে ওর হাতে দিতেই হঠাৎ একটা মিষ্টি গলা শুনে ও ঘুরে তাকায়, 'কাইয়ুম মামা, পুজোর দেশ পত্রিকাটা এসেছে?'
কাইয়ুম জিভ কাটে, আফসোসের গলায় বলে, 'মেঘলা আপা, আপনার জন্য তো অনেকদিন অপেক্ষা করলাম। আজকেই শেষ কপিটা এই স্যাররে দিয়া দিলাম।'
মেখলা ভ্রু কুঁচকে একবার পাশের ছেলেটার দিকে তাকায়, তারপর মুখ ফিরিয়ে বলে, 'মামা, আমার নাম মেঘলা না, মেখলা। আপনি বার বার নাম ভুল করেন। আচ্ছা, আবার কবে নিয়ে আসবেন দেশ?'
কাইয়ুম অনিশ্চিত গলায় বলে, 'আবার কবে যে চালান আসে।'
রাফসান ওদের কথোপকথন শুনছিল, মেয়েটার জন্য মায়া হয়। গতবার ওর সাথেই এমন হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত একজনকে ধরে ইন্ডিয়া থেকে আনিয়েছিল।
রাফসান এবার গলা খাকড়ি দিয়ে বলে, 'এক্সকিউজ মি, কিছু যদি মনে না করেন তাহলে আমার কপিটা আপনি নিতে পারেন। পড়ে ফেরত দিলেই হবে।'
মেখলা ঘুরে তাকায়, দেখে লম্বা ছিমছাম গড়নের একটা ছেলে, শার্টটা সুন্দর করে ইন করে পরা, উপরে কালচে নীল রঙের ব্লেজার। এই গরমে কেউ অমন ফুল হাতা শার্ট ইন করে পরে আছে তার উপর ব্লেজার চাপানো, দেখেই ওর কেমন একটা অস্বস্তি লাগে।
ঠান্ডা গলায় বলে, 'মেয়েদের মোবাইল নাম্বার, এড্রেস জানতে চাওয়ার আপনার এই বুদ্ধিটা ভালো। তবে সব জায়গায় এমন করবেন না। ধন্যবাদ।'
কথাটা বলে মেয়েটা আর দাঁড়ায় না, যাবার সময় বলে যায়, 'মামা, আসলে ফোন দিয়েন।'
রাফসান পুরোই ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়, নেহায়েত ওর খারাপ লেগেছিল তাই মেয়েটাকে বলা। আজকাল মানুষ এমন হয়ে গেছে কেন? সহজভাবে কেউই কোনোকিছু চিন্তা করতে পারে না।
রাফসান মনটা খারাপ করে এবার এগোয়। বাইকের কাছে এসে থমকে যায়, আরে সেই মেয়েটা। রাফসানকে দেখে খর চোখে তাকিয়ে আছে, রাফসান ভয়ই পায়। ও দৃষ্টি ফিরিয়ে পুজো সংখ্যাগুলো বাইকের পেছনে রাখতেই আড়চোখে খেয়াল করে মেয়েটা এই গাড়িতেই উঠছে! বুকটা ধক করে ওঠে। তার মানে এই মেয়েটাই কালকের সেই মেয়েটা!
আজ একদম চেনাই যাচ্ছে না, কালকের সেই নরম মুখটা নেই, কেমন চোখা চোখা কথা বলে। কই ও ভাবছিল মেয়েটার দেখা পেলে জিজ্ঞেস করবে কাল অমন বুক ধড়াস করা কান্না কেন কাঁদছিল। এখন তো দেখা যাচ্ছে সেসব জিজ্ঞেস করা তো দূরের কথা, এমনি কথা বলতে গেলেও তেড়ে মারতে আসবে।
রাফসান মনে করার চেষ্টা করে, মেয়েটার নাম তাহলে মেখলা। মেয়েটা তখন কাইয়ুম মামার উচ্চারণটা শুধরে দিচ্ছিল। কিন্তু মেখলা নামের মানে কী?
গাড়িটা ছাড়ে, রাফসান এবার সরাসরি চেয়ে থাকে গাড়িটার দিকে। মেয়েটা কেমন মুখ গম্ভীর করে বসে আছে, ভুলেও এদিক তাকাচ্ছে না। অবশ্য মেয়েরা নাকি না তাকিয়েও সব দেখতে পায়, আল্লাহ মালুম সেটা কী করে পায়!
গাড়িটা চলে যেতেই রাফসান এবার বাইকটা স্টার্ট করে, মনে মনে ভাবে কাজ নেই মানুষের মনের খবর নিয়ে। একবার সেই খবর নিতে যেয়ে আজও সেই ক্ষত বুকে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অবশ্য এজন্যই অন্যের অমন ক্ষত দেখলে জানতে ইচ্ছে করে তার ক্ষতর কথা।
সেদিন বাসায় ফিরে রাফসান দেখে মা এলাহী আয়োজন করেছে, ইলিশ মাছ ভাজা, পোলাও, মাংস। ও তো অবাক। জিজ্ঞেস করতেই নার্গিস বিরক্তি নিয়ে বলে, 'তোর বাবার পাগলামি, পেনশনের টাকা তুলে আজ একটা বিরাট ইলিশ মাছ নিয়ে এসেছে সাথে মাংস। বলল খাবে। এমন করলে হয়? এত দাম ইলিশের, এক বেলাতেই শেষ। শখ করে এগুলো খাওয়ার উপায় আছে?'
রাফসান হাসে, বাবা বরবারই হাত খোলা। নাক টেনে ঘ্রাণ নিতে নিতে বলে, 'আহ, কী দারুণ ঘ্রাণ বের হয়েছে।'
আজাহার এবার গলা বাড়িয়ে বলেন, 'বের হবে না, চাঁদপুরের ইলিশ। আমি একদম দেখেশুনে নিয়ে আসছি। সব সময় তো আর এমন পাওয়া যায় না। তা তোর মায়ের কথা শুনে মনে হচ্ছে আমি মহা অপরাধ করে ফেলেছি।'
সেদিন রাতে ওরা চারজন খেতে বসে। নার্গিস সবার প্লেটে ইলিশের পিসগুলো দেন। রাফসান আড়চোখে দেখে বাবার চোখেমুখে একটা অদ্ভুত আত্মতৃপ্তি। নিজের টাকায় আজ মাছ কিনতে পেরেছেন, তার একটা আনন্দ। হয়ত ভাবেন রিটায়ারমেন্টের পর এই সংসারে কিছুটা হলেও গুরুত্ব আছে তার এখনও।
খাওয়া শেষে রাফসান এবার আজকের কেনা পুজো সংখ্যাগুলো নিয়ে বসে। প্রথমেই দেশ পত্রিকাটা খোলে না। এটা সবার পরে পুজোর ছুটিতে পড়বে। সুমি মুচকি হেসে বলে, 'তোর এই গল্প পড়ার নেশা আর গেল না। আমি কি একটু পড়তে পারি?'
রাফসান চোখ পাকিয়ে বলে, 'পরে পড়বি। আচ্ছা সুমি, মেখলা নামের অর্থ কি রে?'
সুমি ভ্রু কুঁচকে বলে, 'জানি না তো। তা মেখলা নাম দিয়ে কি করবি শুনি? রহস্যের গন্ধ পাচ্ছি।'
রাফসান একটা ঝাড়ি দিয়ে বলে, 'সারাদিন তো খালি রহস্যোপন্যাস পড়বি। ক্লাসিক কিছু পড়। আচ্ছা, বাংলা অভিধানটা নিয়ে আয় তো।'
সুমি ঠোঁট উলটে অভিধানটা এগিয়ে দিয়ে বলে, 'তুই ক্লাসিক পড়, আমার রহস্যই ভালো লাগে।'
রাফসান হেসে বাংলা একাডেমির ডিকশনারিটা নেয়, তারপর পৃষ্ঠা উল্টাতে উল্টাতে 'ম' সেকশনে চলে আসে। খুঁজে খুঁজে বের করে নামটা, মেখলা মানে হলো - কটিভূষণ, চন্দ্রহার গোট প্রভৃতি অলংকার; কোমরের তাগা।
বাহ, নামটা তো দারুণ। মেঘলা হলে পরিচিত নাম লাগত। মেখলা, একবার উচ্চারণ করে রাফসান। একটু হাসে, মেয়েটা কেমন চোখা চোখা কথা বলছিল, মেয়েদের এড্রেস, মোবাইল নাম্বার চাওয়ার বুদ্ধি নাকি করেছে ও! কথাটা মনে হতেই হো হো করে হেসে ওঠে। সুমি অবাক হয়ে তাকিয়ে বলে, 'এই ভাইয়া, তুই কি পাগল হয়ে গেলি নাকি?'
রাফসান কথা ঘোরায়, তারপর আজকের অনুষ্ঠানের মিস কোহেকাফের ঘটনা বলতেই সুমি হেসে গড়িয়ে পড়ে। মাও এসে যোগ দেয় ওদের সাথে। সুমি এবার মিস কোহেকাফের কথাগুলো অভিনয় করে দেখাতেই ওরা তিনজন এবার হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে। একটা সহজ সুন্দর সুখ ছুঁয়ে থাকে ওদের মুখ জুড়ে।
রাতে ঘুমানোর আগে হঠাৎ একটা কথা মনে হয় রাফসানের, ওই মেখলা নামের মেয়েটার বাসার এড্রেস তো ও জানেই! মেয়েটা যদি জানত ওই সেদিন পিছু পিছু ওদের বাসা পর্যন্ত গিয়েছিল, তাহলে যে কী করত, ভাবতেই আবার হাসি পায়। ঘুমিয়ে পড়ার আগে একটা বুদ্ধি মাথায় আসতেই রাফসান উঠে বসে। একটু ভাবতেই মুখে একটা দুষ্টুমির হাসি ফুটে ওঠে।
৩.
মেখলার খুব মেজাজ খারাপ লাগছে। কত আশা নিয়ে আজ ডিসিসি মার্কেটে গেল কিন্তু ওর প্রিয় দেশ পত্রিকাটাই পেলো না। নাহ, অন্য জায়গায় খুঁজতে হবে। পুজো সংখ্যাগুলো না পড়লে ওর কেমন যেন একটা অপূর্ণ লাগে। আরেকটু আগে গেলেই পেত, ওই আগ বাড়িয়ে কথা বলা ছেলেটাই তো নিয়ে গেল। ইশ, তখন রাগ দেখিয়ে রাজি না হয়ে ভুলই হয়েছে। কী ক্ষতি হতো ছেলেটার কাছ থেকে দেশ পত্রিকাটা নিয়ে নিলে? পড়ে না হয় ফেরত দিয়েই দিত। কেন জানি হুট করে রাগ উঠে গেল, তানভিরের কথা মনে পড়ে গিয়েছিল। না হলে, এমনিতে ও এমন 'rude' না। ছেলেটা ওর গাড়ি পর্যন্ত এসেছিল। এই ছেলেটাও কালকের ছেলেটার মতো মোটরসাইকেল চালায়। তানভিরও চালাত।
তানভিরের কথা মনে হতেই আবার একটা বিষন্নতা ওকে ঘিরে ধরে। ও বুঝে পায় না এই মন খারাপ থেকে ওর মুক্তি কবে? মনের এমন নিয়ন্ত্রণহীন আবেগ যে ওকে দারুণ কষ্ট দেয়। এ থেকে ও পালাবে কী করে?