বন্ধন
পর্ব_৪৭
Bangla Golpo - বন্ধন পর্ব_৪৭ - bangla choti |
কলটা বাজতে বাজতে একসময় কেটে গেল। মায়রা থমকে গিয়ে মোবাইলের দিকে তাকিয়ে ছিল। রিসিভ করার কথাটাও খেয়াল ছিল না একদমই। আবার কল বেজে উঠলে মায়রা একটু দম নিয়ে রিসিভ করে কানে ধরলো মোবাইলটা।
-হ্যালো? মায়রা? কেমন আছিস?
-এই তো ভালো।
-আমাদেরকে একটুও মনে পড়ে না তোর? অবশ্য মনে পড়বে কেনইবা কেন? আমরা কে তোর?
-------------------------------
-দুদিন এসে থেকে যা না মা? তোর বাবা বলছিল। এভাবে একেবারে না আসলে লোকে কি----।
-মা-। লোকে কি বলবে সেটা ভাবার তো দরকার নেই। এই অপয়া মেয়েটা তোমাদের জীবন থেকে একেবারের জন্যই চলে গেছে। সেটাই তো চেয়েছিলে তাই না? আর ওই বাড়িতে যাওয়ার রাস্তা তো আমার বৌভাতের পর দিনই বন্ধ হয়ে গেছে তাই না? ভয় নেই মা এই অপয়া মেয়েটা দরকার হলে এই বাড়িতেই মরবে। তোমাদের আর ক্ষতি করতে বা অসম্মান করতে আসবে না।
-মায়রা? আজ সকালেই তিয়াশের কাছে খবরটা শুনে কতো খুশি হয়েছি তুই কল্পনাও করতে পারবি না। এই সময় তো মায়ের কাছে এসে থাকতে হয়----।
-এমন অনেক কিছুই তো হওয়ার কথা ছিল মা। মেয়ে হয়ে জন্মেছি বলে তো আমার অনেক পাওয়াই অপূর্ণই রয়ে গেছে আজীবন---। আর মেয়ে প্রেগনেন্ট বলে লোকের কথার ভয়ে তাকে বাড়িতে এনে রাখতে হবে না মা। মেয়েরা এই সময়টায় বাবা মায়ের কাছে থাকতে আসে। এই আশায় যে তারা তাকে সমস্ত কষ্ট থেকে আগলে রাখবে। আমার ব্যাপারটা ঠিক বোধ হয় তার উল্টো বুঝলে মা? আমিই সম্ভবত পৃথিবীর একমাত্র মেয়ে যে গর্ব করে বলতে পারি আমার শ্বশুর শাশুড়ি আমাকে আমার নিজের মা বাবার চেয়েও বেশি ভালোবাসে---।
-তুই ঠিকই বলেছিস। এর আগে তোর সাথে কখনো তো এসব নিয়ে কথা হয় নি। এই যে আজ যেমন মুখ ফুটে বলছিস-কখনো তো বলিস নি এমন করে। জানি তুই সুখে আছিস। সুখে থাকবি। এমন অযোগ্য বাপ মায়ের কাছে কেনই বা আসবি বল?
-মা?
-জানিস মায়রা? তিয়াশ হওয়ার পর আমার খুব শখ ছিল একটা মেয়ের। কিন্তু তোর বাবার তো আরেকটা ছেলে চাই। দুই ছেলের বাপ কথাটা শোনা তার আর হয়ে ওঠে নি। তাই তোকে মানুষটা একদমই সহ্য করতে পারত না। আমারও কিছুই করার ছিল না। নিজের সংসারটা বাঁচাতে গিয়ে---।
-বাদ দাও মা। আমার জন্য তোমার সংসার ভাঙুক তা আমি কখনোই চাই না। আর সামনেও চাইব না। ভয় নেই। আমি আসবো না। এ বাড়ির লোকগুলোও ভিষণ ভালো, জানোই তো? উনারা যাই হোক আমাকে অলক্ষী বলে মাঝ রাস্তায় অন্তত ছেড়ে যাবে না। তাই আমার বোঝা বইতে হবে এই ভয়টা পেও না। যা কিছু হয়ে যাক না কেন তোমাদের ঘাড়ের বোঝা হবো না কখনোই।
-কি হয়েছে রে মায়রা? আয়ানের সাথে-----।
-কিছুই হয়নি মা। রাখছি---।
মায়রা কলটা কেটে গিয়ে বিছানায় বসেই কাঁদতে লাগলো। আসলেই তো মা তার নিজের স্বামীর সংসারে টিকে থাকার জন্যই ওর সাথে এমন ব্যবহার করেছে। নিজের সংসার টিকিয়ে রাখতে একটা মেয়ে তো কত কিছুই করে। ওর মা না হয় ওর সাথে খারাপ ব্যবহারই করেছে- এ আর এমন কি! আর নিজের ভাগ্য নিয়ে মায়রা আর কি বলবে? কখনো তো বাবা মায়ের ভালোবাসায় স্পর্শটুকু পেল না। এখন মন খারাপের সময়টাতে একটু মায়ের কোলে মুখ ডুবিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু সেটাও তো হবার নয়। ওই বাড়িতে তো মায়রা কখনো যাবে না। অন্তত কেউ লোকের কথা শোনার ভয়ে নিতে চাইলে তো নয়ই।
মায়রা খাট থেকে উঠে আলমারি থেকে মায়ের দেয়া বিয়ের গয়নার বাক্সটা বের করলো। মায়ের দেয়া গয়নাগুলো যত্ন করে আলাদা করে রেখো দিয়েছে মায়রা। জীবনে প্রথমবার ওইদিনই মায়রা মায়ের মুখে ভালো করে কথা শুনেছে। নইলে অপয়া, অলক্ষী ছাড়া তো মা ওকে কথাই বলতে পারেন এটা মায়রা জানতই না। মায়রা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গয়নার বাক্সটা আবার আলমারিতে রেখে দিলো।
-এই গয়নার উপরেও আমার কোনো অধিকার নেই মা। বিয়ের দিন গয়নাগুলো দিয়েছিলে যাতে লোকে এটা না বলে তোমরা মেয়েকে খালি হাতে পাঠিয়েছ--। এই গয়না তো আমার জন্য না। লোকের মুখ বন্ধ করার জন্য। এই গয়না তাই আমি রাখবও না। ভাইয়ার বিয়েতে তোমার গয়না তুমি ফিরত পেয়ে যাবে মা। যে তোমার সম্পদ ধারণের যোগ্য, সম্পদ তার কাছেই পৌঁছে যাবে।
সন্ধ্যার দিকে তিথি এসে মায়রাকে রেডি হতে হেল্প করলো। লাল রঙা কাতান শাড়ি পড়িয়ে দিয়ে সুন্দর করে সাজিয়ে দিলো। তারপর চুলগুলো হালকা করে খোঁপা করে বেলিফুলের মালা জড়িয়ে দিলো। মায়রা তিথির ছেলেমানুষিতে হাসছে। এই পিচ্চি পরীটা জীবনে আসায় পুরো জীবনটাই বদলে গেছে মায়রার। নয়তো আজ কোথায় থাকতো মায়রা কে জানে!
সাতটার একটু আগে মায়রা, তিথি, তিয়াশ, মায়রার শ্বশুর শাশুড়ি সবাই মিলে আয়ানের পাঠানো ঠিকানায় 'সেইফটি ফর উইমেন' এর পোগ্রামের ভেন্যুতে আসলো। আয়ান এসে সবাইকে বসার জন্য সিট দেখিয়ে দিয়ে গেল। মায়রার দিকে তাকিয়ে হাতের ইশারায় জানালো ভিষণ সুন্দর লাগছে। মায়রা লাজুক হাসল। পার্টিসিপেট করা কোম্পানির ইমপ্লোয়িরা সামনের দিকে বসেছে। সেখানে গিয়ে আয়ানও বসলো। মায়রার কেমন অস্বস্তি লাগছে। সাথে টেনশনও। তিথি বুঝতে পেরে মায়রার হাত ধরে বসলো।
-আরে ভাবি? টেনশন করো না। ভাইয়ার প্রজেক্টগুলোয় মাঝেমাঝেই এমন হয়। শেষ মূহুর্তে গিয়ে ওরা সব ঠিক করতে পারে---।
-কিন্তু--। উনাদের তো---।
-আরে লক্ষী ভাবি। দেখো আজও ভাইয়াই প্রজেক্টটা পাবে৷ আমি ড্যাম সিউর---৷
একটু পরে কোট টাই পরা একজন ভদ্রলোক উঠে মঞ্চে গিয়ে দাঁড়ালেন।
-গুড ইভনিং লেডিস এন্ড জেন্টেলম্যান। আমি সেইফি ফর উইমেনের চেয়ারম্যান জিহাদ চৌধুরী। আমরা আজকের পোগ্রামে এমন একটি প্রজেক্ট সবার কাছে তুলে ধরব যার মাধ্যমে আমরা মেয়েদের সেইফটি একটু হলেও নিশ্চিত করতে পারব। এই প্রজেক্টটির প্রপোজাল দিয়েছিলেন গত একবছর আগে দিবাশা কোম্পানি থেকে মিস্টার আয়ান আহমেদ। উনার পাশাপাশি আমাদের সেইফটি ফর উইমেনের রিচার্স টুলের জন্য বেশ অনেকেই প্রজেক্ট প্রপোজাল জমা দিয়েছিলেন। তার মধ্যে এই প্রজেক্টটির ফিজিক্যাল এপিয়ারেন্সের আমরা অনুমোদন দিয়েছিলাম৷ আজ বিকেলে প্রজেক্টটির টেস্টিং করা হয়েছে। সাথে আরো কয়েকটি প্রজেক্টেরও টেস্টিং করা হয়। কোনটি সফল হয়েছে, কোনটি হয়নি।
এখন আমরা আমাদের সেইফটি ফর উইমেনের ২০১৯ সালের রিসার্চ টুলের বিজেতার নাম ও কোম্পানির নাম ঘোষণা করতে যাচ্ছি। যে কোম্পানিটি এবারের প্রজেক্টটি পাবেন তাদের প্রোডাক্ট আমরা আমাদের এনজিওর জন্য স্পন্সর করবো। আর এক বছরের জন্য এই প্রোডাক্টের ফ্রি এ্যাডভারটাইজমেন্ট করা হবে সেইফটি ফর উইমেনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানগুলোয়।
যাই হোক। আজকে আমাদের সেইটি রিচার্স টুলের বিজয়ী হলেন মিস্টার আয়ান আহমেদ এন্ড কোম্পানী দিবাশা। আমি মিস্টার আয়ান আর দিবাশার এমডি কে মঞ্চ আসার জন্য অনুরোধ করছি।
বিকেলে টেস্টিংয়ের সময় আয়ান বা দিবাশার কেউই সেখানে ছিল না। ইভেন ওদের প্রপোজাল অনুযায়ী ব্রেসলেটটা লোকেশন মেসেজ করতে পেরেছে কিনা সেটাই কেউ জানে না। এখন প্রজেক্টটা পেয়েছে শুনে আয়ান খুশিতে পাগল হয়ে যাওয়ার জোগাড়। তার এক বছরের পরিশ্রম সফল হয়েছে। খুশির চোটেই আরিশাকে জাপটে জড়িয়ে ধরলো আয়ান৷ আয়ান আরিশার হাত ধরে মঞ্চের দিকে এগিয়ে গেল। আরিশা আর আয়ানের হাতে সেইফটি ফর উইমেনের চেয়ারম্যান সম্মাননা স্মারক তুলে দিলেন। আরো বেশ কিছু স্মারকলিপি তুলে দিলেন। তারপর আয়ানকে কিছু বলতে বলা হলো।
-প্রজেক্টটা পেয়ে গেছি এটা আমার এখনো স্বপ্নের মতোই মনে হচ্ছে। সেইফটি ফর উইমেনের এই রিসার্চ টুলস নিয়ে কাজ করতে পেরে অনেক কিছুই শিখতে পেরেছি। এই সফলতার ক্রেডিট পুরোটাই যায় আমার পার্টনার মিস আরিশা তাহনুমা চৌধুরী আর দিবাশাকে। সি ওয়াজ মাই ইন্সপিরেশন আর দিবাশা হলো তার ফলাফল--।
আয়ানের বক্তব্যটা শেষ হওয়ার আগেই মায়রা সিট থেকে উঠে চলে এলো। আয়ানের আরিশাকে জড়িয়ে ধরা, সমস্ত সফলতর ক্রেডিট দেয়া একদম অসহ্য লাগছে মায়রার কাছে। অসহ্যের চেয়েও এখানে বসে আয়ানের মুখে আরিশার কথা শুনতে বেশিই রাগ লাগছে। মায়রার বারবার মনে হচ্ছে আসলেই ও নিজের যোগ্যতার চেয়ে বেশিই দাবি করে ফেলেছিল। আসলেই এতো অযাচিত ভালোবাসা পাওয়ার ও আসলেই যোগ্য না। কান্না চেপে মায়রা ভেন্যু থেকে বেরিয়ে আসতে যাবে এমন সময় কারো সাথে একটা ধাক্কা খেল। লোকটা একবার মায়রার দিকে তাকিয়ে সরি বলে সরে গেল। মায়রা কোনমতে বেরিয়ে এলো হলরুমটা থেকে।
মায়রা বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে চোখের পানি মুছছে বারবার। একটু পরে আবার চোখটা ঝাপসে হয়ে আসছে। এতো মুছেও কাজ হচ্ছে না। এমন সময় কাঁধে হাতের স্পর্শ পেয়ে পিছনে ফিরে মানুষটাকে দেখে তাড়াতাড়ি চোখ মুছে নিলো।
-আয়ান কাজটা একদম ঠিক করে নি মায়রা। এর শাস্তি ওকে পেতেই হবে। শাস্তি দিতে পারবি না? কিন্তু দেখ রাগ করে বাপের বাড়ি গিয়ে বসে থাকলে হবে না কিন্তু----।
মায়রা চোখ মুছে সামনে দাঁড়ানো মানুষটার কথাগুলো মন দিয়ে শোনার চেষ্টা করলো। আয়ানকে শাস্তি দেয়ার তো কিছু নেই। তার মনের ফিলিংসটা সে প্রকাশ করেছে। এতো তো দোষের কিছু নেই। আর আয়ানকে শাস্তি দেয়ার জন্য হলেও নিজের বাবার বাসায়ও তো ওর যাওয়া হবে না। তবু কিছুদিনের জন্য সব ছেড়ে কোথাও একটা চলে যেতে ইচ্ছে করছে মায়রার। আর এক দন্ডও ভালো লাগছে না এসব। অন্তত আজকের ঘটনার পরে তো নয়ই। তাই মানুষটার দেখানো পথেই পা বাড়ালো মায়রা। আপাতত কি, কেন এসব না ভেবে এসব থেকে একটু দূরে গিয়ে থাকতে চাইছে মেয়েটা। সব চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে মায়রা গাড়িতে গিয়ে বসে গা এলিয়ে দিয়ে বসলো। ড্রাইভারকে সব বলে দেয়া হয়েছে কি করতে হবে। এসব নিয়ে মায়রা আর মাথা ঘামালো না। যা ঘটছে ঘটুক। আপাতত গাড়ির সিটে গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজলো মায়রা। আর অজানার উদ্দেশ্য পাড়ি জমালো গাড়িটা ওকে নিয়ে।